নিজস্ব প্রতিবেদক : নরসিংদীর ৫টি সংসদীয় আসনের মধ্যে চারটি আসনে টান টান উত্তেজনায় ভোটের মাঠ গরম করে রেখেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থী ও সমর্থকরা। এসব আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের টেক্কা দিতে সমান তালে মাঠে প্রচারণা চালাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এতে জেলার ৫টি আসনের মধ্যে ৪টি আসনেই নৌকা ডুবার আশংকা করছেন এখানকার ভোটাররা।
জানা যায়, জেলার প্রতিটি আসন আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র থেকে প্রার্থী হয়েছেন একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা। সেই সব স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিজয়ী করতে মাঠে নেমে ভোটারদের কাছে ঈগল প্রতীকে ভোট চাচ্ছেন সে সব এলাকার আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকর্মীরা। আবার কেউ কেউ প্রকাশ্যে না এসে সে সব এলাকার নৌকার মাঝিকে ডোবাতে আড়াল থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। আর এতেই রীতিমতো জেলার গুরুত্বপূর্ণ ৫টি আসনের মধ্যে ৪টি আসনেরই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের ডোবার আলোচনা সমালোচনায় মেতে উঠছে ভোটাররা।
নরসিংদীতে রয়েছে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ৫টি আসন। যেখানে গত ১৫ বছর ধরে ৫টি আসনই ধরে রাখছে আওয়ামী লীগ। সেখানে এবার ৫টি আসনের মধ্যে ৪টিতেই আসন হারাবার ভয় রয়েছে নৌকার প্রার্থীদের। তবে এবার ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনের মাঠে নামা আওয়ামী লীগের নেতাদের দখলে যাওয়ার আশংকা রয়েছে জেলার গুরুত্বপূর্ণ ৪টি আসন।
নরসিংদী-১:
২০০৮ সালে ১৬ হাজার ৬’শ ৫১ ভোটে তৎকালীন বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মনোনীত প্রার্থী খায়রুল কবির খোকনকে পরাজিত করে নরসিংদী-১ সদর ও সংসদের ১৯৯ নং আসনের দায়িত্ব পায় মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরো (বীর প্রতীক)। তারপর থেকে ২০১৪ ও ২০১৮ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে জয় লাভ করে টানা তিন বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এবার ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ফের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান ৩ বারের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরু। তবে এবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া এতোটা সহজ হবে বলে মনে করছেন না জেলাবাসী। কারণ দুই বারের নির্বাচিত সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান কামরুল এবার হিরু’র বিরুদ্ধে ঈগল প্রতীকের নির্বাচন করবেন। ভোট সুষ্ঠু হলে ভালো লড়াই হবে দুই প্রার্থীর মধ্যে। দুজনই সমানতালে প্রচার চালাচ্ছেন। পক্ষ-বিপক্ষে হুমকি আর গ্রেপ্তারে উত্তেজনাও তৈরি হয়েছে।
দুটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত নরসিংদী সদর আসনে ভোটার আছেন ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪৩৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৩৯ জন; ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৯৭ জন নারী। ভোটাররা কামরুলকে বিজয়ী করবেন, নাকি হিরুকে পর পর চারবার জাতীয় ‘নায়ক’ বানাবেন, তা জানতে অপেক্ষায় থাকতে হবে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত।
নরসিংদী-২:
২০০৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) থেকে নির্বাচিত টানা ৪ বারের সংসদ সদস্য ড. আবদুল মঈন খানকে ২৯ হাজার ৮’শ ২৮ ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আসন ধরে রাখে তারই ছোট কামরুল আশরাফ খান পোটন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান পুণরায় দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন। এবারেও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নৌকার কান্ডারী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এই নেতা। এবার নরসিংদী-২ আসনটিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির মনোনীত এ এন এম রফিকুল আলম সেলিম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তবে আসনটিতে তার অবস্থান অনেকটাই নড়বরে থাকায় এবারে নরসিংদী-২ এবং জাতীয় সংসদের ২০০ নং আসনটিতে নৌকার প্রার্থী ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান কোন প্রকার চাপ ছাড়াই ধরে রাখতে পারবেন বলে আশাবাদী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের।
নরসিংদী-৩:
নরসিংদী-৩ শিবপুর জাতীয় সংসদের আসন নং ২০১। আসনটিতে ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপির সাবেক মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া’র দখলে ছিলো। পরে ২০০৮ সালে সংস্কারপন্থী হওয়ায় বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি নেতা আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। সে সময় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জহিরুল হক ভূইয়া মোহন কাছে ২৬ হাজার ৮’শ ০৪ ভোটে পরাজিত হয়ে আসন ছাড়েন আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। পরে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হয়ে দলের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মোল্লার কাছে পরাজিত হন জহিরুল হক ভূইয়া মোহন।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে ফের আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জহিরুল হক ভূইয়া মোহন। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জহিরুল হক ভূইয়া মোহনকে বাদ দিয়ে নরসিংদী-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন ফজলে রাব্বি খান। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য রবিউল আওয়াল খান কিরণের ছেলে ও প্রয়াত উপজেলা চেয়ারম্যান প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হারুনুর রশিদ খানের ভাতিজা। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আ.লীগ মনোনীত প্রার্থী রাব্বী’র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন।
সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হওয়ায় তার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাছাড়া বিগত পাঁচ বছর তিনি পুরা নির্বাচনী আসনের চষে বেড়িয়েছেন। তার এই জনপ্রিয়তার কাছে নৌকার প্রার্থী ফজলে রাব্বি খান অনেকটা অস্থায়ী আছে এতে এ আসনে নৌকার ভরাডুবি হতে পারে বলে সাধারণ ভোটাররা মনে করছেন। । এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় কোন না থাকায় অনেকটা স্বাধীনভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। এতে নরসিংদী-৩ শিবপুর আ.লীগের স্থানীয় বেশিরভাগ নেতৃবৃন্দই সিরাজুল ইসলাম মোল্লা’র পক্ষে মাঠে কাজ করছেন। এই আসনে নৌকা ডুবলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই এমনটাই মনে করছেন ভোটাররা।
নরসিংদী-৪:
মনোহরদী-বেলাবো নরসিংদী-৪ এর ২০২ সংসদীয় আসন। ২০০৮ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীনকে ৬৭ হাজার ২’শ ভোটে পরাজিত করে জাতীয় সংসদের আসনে বসে এ্যাড. নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। তারপর থেকে ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে টানা ৩ বার সহ মোট চার বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পান নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন এমপি। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় লাভের পর বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রী’র দ্বায়িত্ব পান। তবে এবারে নরসিংদী-৪ আসনে জয় এতোটাও সহজ হবে না বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতারা।
এ আসনে তার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন মনোহরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু। তিনি একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশায় বিগত সময়ে বেলাবো-মনোহরদী নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। সাইফুল ইসলাম খান বিরু সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক মন্ত্রী নুরুদ্দিন খানের ভাতিজা হওয়ায় এলাকায় তার রয়েছে ব্যাপক প্রভাব প্রতিপত্তি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে এই নেতা নির্বাচনী এলাকার দুই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন গ্রাম পাড়া মহল্লা চষে বেড়াচ্ছেন। যাচ্ছেন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ঈগল প্রতিকে ভোট প্রার্থনা সহ ভোটারদের দোয়া কামনা করছেন তিনি। ভোটাররাও শোনাচ্ছেন আশার বাণী।
তাছাড়া বেলাব-মনোহরদী এই দুই উপজেলার আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাদের মনে জানা অজনা ক্ষোভ নিয়ে তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী বীরু’র হয়ে মাঠে কাজ করছেন। ইতিমধ্যে বেলাবো-মনোহরদীর বাতাসে ভোটারদের মাঝে পরিবর্তনের সুর শোনা যাচ্ছে।
নরসিংদী-৫:
নরসিংদী-৫ আসনটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রায়পুরা উপজেলার ২৪টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভা নিয়ে ঘটিত। ১৯৯৬ এর পর থেকে অদ্যাবদি পর্যন্ত এ আসনটি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু এমপি। ২০৩ নং সংসদীয় আসনটি থেকে টানা ৫ বার সহ মোট ৬ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। জেলার প্রবীণ এই নেতাকে সম্মানিত করতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও দলীয় মনোনয়ন দিয়ে তার হাতে নৌকা তুলে দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এবার দলীয় নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কোন ধরনের বাঁধা না দেওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী। ইতিমধ্যে তিনি রায়পুরার ২৪টি ইউনিয়নে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে তাকে। এতে করে এ আসনটিতে এবার নৌকা ও ঈগল প্রতীকের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন অনেকে৷ তবে তবে বর্ষীয়ান নেতা রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর এলাকায় এখনো রয়েছে তার বেশ জনপ্রিয়তা। এখনো তিনি শক্ত হাতে রায়পুরা পরিচালনা করেন। দলীয় কিছু নেতা কর্মী তার উপর রাগ অভিমান নিয়ে ঈগল প্রতীকের প্রার্থীর হয়ে কাজ করছেন। তাই এ আসনটিতে নৌকার জয় এতোটা সহজ হবে বলে মনে করছেন না ভোটাররা।
১৯৯৬ সাল থেকে নরসিংদী-৫ রায়পুরা আসনটি আওয়ামী লীগের রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু’র দখলে আছে। তাহলে কি আওয়ামী লীগ নেতাদের কারণেই এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্রের দক্ষলে যাবে এ আসনটি…!! জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে জানুয়ারি’র ৭ তারিখ পর্যন্ত। তবে প্রবীণ ভোটারদের ভাষ্য, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু জাতীয় নেতা। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে জয় লাভ করেন রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। এরপর ১৯৯১ সালে ফের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান তিনি। সে সময় বিএনপি নেতা আব্দুল আলী মৃধার কাছে তিনি পরাজিত হন।
তারপর থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপি নেতা আব্দুল আলী মৃধাকে পরাজিত করে বিজয়ী হন তিনি। পরে ২০০৮ সালে বিএনপি নেতা জামাল আহম্মেদ চৌধুরীকে পরাজিত করে বিজয়ী হন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন প্রবীণ এই নেতা। সর্বশেষ ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নরসিংদী-৫ আসন থেকে ফের বিএনপি নেতা আশারাফ উদ্দিন বকুলকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। এবারও জয়ের ধারা অব্যাহত থাকলে সপ্তম বারের মতো নির্বাচিত হয়ে উন্নয়ণের ধারা অব্যাহত রাখবেন প্রবীণ এই নেতা।