সাইফুর নিশাদ, মনোহরদী প্রতিনিধি : প্রতিদিন মধ্যরাতে মা, মা বলে কাদঁতে দেখা যায় এক বালককে। মাঝে মধ্যে আবার মা, মা বলে কাদঁতে কাদঁতে মামার বাড়ির দিকে ছুটে সে। কেননা মা যে নদীর ওপারে নানু বাড়িতে ছোট ভাইটিকে নিয়ে থাকে। রাতে তার কান্নার শব্দে প্রতিবেশীরা ছুটে আসলেও আসেনা মা। জন্মের পরে মায়ের কোলে বড় হওয়ার কথা থাকলেও এটায় এখন সৌরভের জীবনের নির্মম বাস্তবতা।
এতক্ষণেও আন্দাজ করতে বাকি নেই পাঠকের যে এটি একটি হতভাগার দৈনন্দিন জীবনের নির্মম গল্প। বলছিলাম নরসিংদির মনোহরদী উপজেলার মনতলা গ্রামের ফজলু-কুলসুম দম্পতির প্রথম সন্তান বাক প্রতিবন্ধী সৌরভের কথা।
পৃথিবীতে প্রতিটি সন্তানের জন্মই আনন্দের। কিন্তু জন্মই যেন আজন্ম পাপ কথাটির মূর্ত প্রতীক যেন সৌরভ। তার জন্মের পর পরিবারে খুশির জোয়ার থাকলেও সেখানে ভাটা পড়তে সময় নেয় মাত্র ৪ বছর। কেননা যে সময়টাতে সৌরভের মা-বাবাকে ডেকে মন ভরানোর কথা ঠিক সেই সময়ে সৌরভ অনবরত হাসির রাজ্যে ডুবে থাকে।
তাকে ডাকলেও হাসে, খেতে বললেও হাসে, রাগ দেখালেও হাসে, পড়ে ব্যাথা পেলেও হাসে। সে নানান অঙ্গভঙ্গীতে তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারলেও মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারতো না।
তখন-ই তার মা-বাবা রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের শরণাপন্ন হলে ডাক্তার তাকে জন্মগত প্রতিবন্ধী বলে জানান। কিন্তু আশ্বাস পান নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া ও বড় হওয়ার সাথে সাথে সৌরভের মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলার পরে সৌরভের মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন না আসলে হতাশ হয়ে তার চিকিৎসায় গাফিলতি দেখা দেয় যা এখনো পর্যন্ত বন্ধই আছে।
সেখানেই কি শেষ? হৃদয়বিদারক ঘটনা কেবল শুরু !
মন খারাপ ও হতাশার মধ্যে নিয়তির লিখন এক প্রকার মেনে নিয়েই চলতে থাকে তাদের সংসার। তার বাবা ফজলু ছিলেন প্রবাসী। হঠাৎই নেমে আসে পরিবারটিতে অশান্তির ছায়া। তারা বাবাকে বিদেশে থেকে দেশে পাঠিয়ে দেয় জটিল রোগের কারনে। দেশে আসলে এসব নানা জটিলতার কারণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এই দম্পতির সংসার।
অনেকটা বাধ্য হয়েই সৌরভের মা সংসার ত্যাগ করে বাপের বাড়িতে পাড়ি জমান। সৌরভের পিতাও হয়ে যায় দেশান্তরি। আবির্ভাব হয় বছর দুয়েক পর পর।
এভাবেই শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেওয়ায় পৃথিবীতে সবচেয়ে নিরাপদ, নির্ভরতার স্থান মাকেও যেন পাশে পেলেন না সৌরভ। আর বাবা থেকেও যেন নেই! তার দায়িত্ব এসে পড়লো পরিবারের সর্বশেষ সদস্য তার দাদি হামিদা বেগমের (৮০) উপর।
সোমবার (৩০ জানুয়ারি) সরেজমিনে হামিদা বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বর্তমানে ১৬ বছর বয়সী সৌরভের শারীরিক বৃদ্ধি ঠিক থাকলেও মুখে বুলি ফুটেনা। চোখেও শতভাগ দেখতে পায়না। হাতেও এক মুঠো ভাত তুলে খাবার শক্তি নেই। গোসল থেকে নিয়ে ঘুম পারানো পর্যন্ত সকল দায়দায়িত্ব গত ১০ বছর ধরে ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধার দেখতে হয়। সৌরভ এক জায়গায় স্থির থাকেনা। এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। মাঝে মধ্যে ২/১ দিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যায়। বয়স্ক বৃদ্ধার কান্নার আহাজারি আর এর ওর খোজাখুজিতে সন্ধান মেলে সৌরভের।
সৌরভের দাদি জানান, এ পর্যন্ত প্রতিবন্ধী ছেলেটি নিজে কোন সরকারি সহায়তা পায়নি। তবে গত বছর দুয়েক আগে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাহাবুবুর রহমান জামিল একটি প্রতিবন্ধী ভাতা করে দেন। এতে মাস তিনেক পর পর কিছু টাকা পায়। এ টাকা দিয়ে ওষধ পত্রতো দূরের কথা ঠিকমতো তিনবেলা আহার জোটাতে পারেনি।
দাদি আরও জানান, মাঝে মধ্যে মনে হয় নিজে আত্বহত্যা করে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নেই! কিন্তু আমি মরে গেলে প্রতিবন্ধী ছেলেটির কি হবে? এ আশঙ্কায় আত্মহত্যাও করতে পারিনা। আমি মরে গেলে আমার নাতিটার কি গতি হবে আল্লাহ পাক-ই ভালো জানেন। এবলেই বৃদ্ধাটি কাঁদতে কাঁদতে আচলে মুখ লুকোতে থাকেন। সে সময় সৌরভ উপস্থিত থাকলেও তার চিরচেনা হাসিটিই দেখা যায় মুখে।
এমতাবস্থায় সমাজের বিত্তশালীদের কাছে সৌরভের বৃদ্ধা দাদির একটায় অনুরোধ সৌরভের পূর্নাঙ্গ চিকিৎসা চালিয়ে যেতে মানবিক দিক বিবেচনা করে হলেও এগিয়ে আসতে। যাতে সৌরভ ফিরতে পারে স্বাভাবিক জীবনে এবং পরনির্ভরশীলতা ছাড়ায় যেন জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারে।
সৌরভের বাবাকে বাড়িতে না পেলে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, বর্তমানে আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোটখাটো চাকরি করে নিজের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছি। সব কিছুর পরেও সৌরভের আহার জুটাতে পারলেও মায়ের অভাব আমি পূরণ করতে পারিনা। সৌরভ মায়ের কাছে থাকতে চাইলেও মায়ের কোন সাড়া পাওয়া যায়না। মাস ছয়েক পর পর কিছু সময়ের জন্যে মায়ের দেখা পেলেও মায়ের আচলে মাথা রাখতে পারেনা।
স্থানীয় এক প্রতিবেশী জানান, সৌরভের জন্মের বছর তিনেক পরে জন্ম গ্রহন করেন ফুটফুটে আরও একটি ছেলে সন্তান। সেই ছেলে সন্তানকে নিয়েই বাপের বাড়িতে থাকেন সৌরভের মা। সেই ছেলেটি মায়ের আদর শতভাগ পেলেও পায়না সৌরভ। বুকভাঙা কাতর গলায় মা মা বলে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়ে সৌরভ। প্রতিদিন দিন পেরিয়ে রাত হয়, রাত পেরিয়ে নতুন দিনের উদয় হয়। তবুও বাবা-মায়ের মুখখানা একটি বারের জন্যেও উদয় হয়না সৌরভের দৈনন্দিন জীবনে।